Breaking News

নূপুর থেকে ঢালিউডের একজন শাবনূর হয়ে উঠার গল্প!

ঢাকা’ই চল’চ্চিত্রের নব্বই দশকের দর্শকপ্রিয় নায়িকা শাবনূর। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি যেভাবে সমৃদ্ধ করেছেন, তা আজীবনই মনে রাখবে এ দেশের সিনে’প্রেমীরা। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় দক্ষতা দেখিয়ে শাবনূর যেভাবে দর্শকদের মন জয় করে নিয়েছেন, তাতে তাকে আদর্শ হিসেবে মানেন এই প্রজন্মের অনেক নায়িকা।
নতুন ছবির জন্য পাত্রপাত্রী খুঁজছিলেন গুণী নির্মাতা এহতেশাম। একাধিক ছবিতে নতুন নায়ক–নায়িকার অভিষেক ঘটানো এই নির্মাতার অফিসে একদিন বাবাকে নিয়ে হাজির হন নূপুর নামের একটি মেয়ে। তাঁর ইচ্ছা ছবিতে অভিনয় করার। তাঁরা শুনেছেন এই নির্মাতা নতুন ছেলেমেয়েদের নিয়ে শুটিং করেন। তাই এই অফিসে আসা। স্কুলে পড়া ১২ কি ১৩ বছর বয়সের মেয়েটিকে প্রথম দেখায়ই পছন্দ হয় নির্মাতার। নূপুরের মধ্যে গল্পের সেই মেয়েটিকে পেয়ে যান এহতেশাম। বান্ধবীদের নিয়ে দল বেঁধে পুরো গ্রাম ঘুরে বেড়ানো। এ জন্য বাপের কাছে অভিযোগও কম আসে না, এমন পাণ্ডুলিপির দুরন্ত সেই কিশোরী মেয়েটিকে হিরোইন হওয়ার জন্য যা যা দরকার, নির্মাতা তার জন্য দুই বছরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুরে শুরু হয় ‘চাঁদনী রাতে’ ছবির শুটিং।

চিত্রনায়িকা শাবনুর l ছবি সংগৃহীত

ঢালিউডের নায়ক নির্ভর ইন্ডাস্ট্রিতে দাপটের সঙ্গে অভিনয় দিয়ে ইতিহাস সৃষ্টিকারী নায়িকার নাম শাবনূর। নিজের সময়ের প্রায় সব নায়কের সঙ্গেই জুটি বেঁধে কাজ করেছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সফল ছিলেন নায়ক সালমান শাহের সঙ্গে জুটি বেঁধে।
নির্মাতা এহতেশামের হাত ধরে ১৯৯৩ সালের ১৫ অক্টোবর বড় পর্দায় আবির্ভাব ঘটে চিত্রনায়িকা শাবনূরের। সেই হিসেবে এরইমধ্যে কেটে গেছে ২৬টি বছর। চলচ্চিত্রের ক্যারিয়ারে চলছে শাবনূরের রজতজয়ন্তী। প্রথম অভিনীত ছবির নাম ‘চাঁদনী রাতে’। শাবনূরের নায়ক ছিলেন সাব্বির। ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফলতা না পেলেও হাল ছাড়েননি নায়িকা।

প্রথম ছবির পর জুটি বাঁধেন সালমান শাহের সঙ্গে। এই জুটির মাধ্যমেই বদলে যায় তাদের জীবন। সালমান শাহের সঙ্গে ১৪টি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শাবনূর। যার সবগুলোই ছিল ব্যবসা সফল। জহিরুল হক পরিচালিত এ জুটির প্রথম ছবি ‘তুমি আমার’ ১৯৯৪ সালে মুক্তি পায়। একই বছর শাহ আলম কিরণ তাদের নিয়ে ফারুক-কবরী জুটির ‘সুজন সখী’ চলচ্চিত্রের রঙিন পুনঃনির্মাণ ‘সুজন সখী’ নির্মাণ করেন। ১৯৯৫ সালে ‘স্বপ্নের ঠিকানা’, ১৯৯৬ সালে ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘তোমাকে চাই’, ১৯৯৭ সালে শিবলি সাদিক পরিচালিত ‘আনন্দ অশ্রু’ ছবিগুলো তুমুল সাড়া ফেলে ইন্ডাস্ট্রিতে।

সালমানের অকাল মৃত্যর কারণে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলেন শাবনূর। সালমানের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে তার অসমাপ্ত সিনেমাগুলোর দৃশ্য এবং গানগুলো ডামি দ্বারাই সম্পূর্ণ করা হয়েছিল। যেটা শাবনূরের জন্য ছিল বিশাল বড় ধাক্কা। সেই ডামির সাথেই ছয়টি সিনেমা (জীবন সংসার,চাওয়া থেকে পাওয়া,আনন্দ অশ্রু,বুকের ভিতর আগুন,স্বপ্নের নায়ক ও প্রেম পিয়াসী) করতে হয়েছিল শাবনূরকে। এই ডামির সাথেই একজন শাবনূরকে এতোগুলো কাজ করতে হয়েছিল। একদিকে তার তখনকার সর্বাধিক সিনেমার সহকর্মীর অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু, অন্যদিকে সেই সালমানের অবর্তমানে তার ডামির সাথে বিভিন্ন ধরনের হাসি-কান্নার এক্সপ্রেশন দিয়ে কাজগুলো করে যেতে হয়েছিল। একটা অস্বস্তিকর অবস্থার মধ্যে শাবনূর তখন ছিল!
সালমানের অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুতে তার নামও ভালভাবে জড়িয়ে একের পর এক বিতর্কিত হয়েছিলেন। ফলে তাকে অনেক বেশি ইমেজ সংকটে পড়তে হয়েছিল। যেটা একজন তারকার জন্য খুবই স্পর্শকাতর বিষয় ছিল। এমন অনেক সম্ভাবনাময় তারকার দৃষ্টান্ত আছে, যারা এই ইমেজ সংকটে পড়ে ক্যারিয়ার থেকে শুরু করে জীবনের অনেক কিছুই হারিয়ে ফেলেছিল।

চিত্রনায়িকা শাবনুর l ছবি সংগৃহীত

কিন্তু শাবনূরের ক্যারিয়ারে এটা অনেক বড় ধাক্কা হবার কথা থাকলেও তা হতে পারেনি তার প্রতিভার জোরে। তার ক্যারিয়ার তখনও সবচেয়ে উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলছিল। ‘৯৭সালেও শাবনূরের ১১টি সিনেমা মুক্তি পায়। যার বেশিরভাগে তার অভিনয় সমালোচকদের পাশাপাশি দর্শক মহলেও নন্দিত হয়। আনন্দ অশ্রু,কে অপরাধী,শেষ ঠিকানা,উজানা ভাটি, প্রেম থেকে তুমি শুধু তুমি ইত্যাদি সিনেমাতে তার অভিনয় এতটাই নন্দিত হয় যে সবাই তাকে সময়ের সেরা অভিনেত্রীর আক্ষা দিতে থাকে।

এদিকে সালমানের অবর্তমানে উঠতি বা নতুন সব নায়কেরা শাবনূরের সাথে জুটি গড়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। যেখানে অমিত হাসান,শাকিল খান থেকে শুরু করে হেলাল খানরা তো রীতিমতো সিনেমার প্রযোজক হয়ে শাবনূরের সাথে জুটি গড়ার জন্য সচেষ্ট ছিল। চিত্রনায়ক রিয়াজ তখন শাবনূর ছাড়া কাজই হাতে নিতে চায় নি। সালমান শাহ পরবর্তী সময়ে শুধু শাবনূরের সঙ্গে জুটি বাঁধার কারণেই অনেক নায়কই পায়ের তলায় মাটি পেয়েছিলেন ধরা যায়।

সালমানের পর নায়ক রিয়াজের সঙ্গে জুটি বেঁধেও অসংখ্য ছবি উপহার দেন শাবনূর। এই নায়কের বিপরীতে ১৯৯৭ সালে ‘মন মানে না’ ও ‘তুমি শুধু তুমি’ মুক্তি পায়। এরপর ১৯৯৯ সালে রিয়াজ-শাবনূর জুটির ‘ভালোবাসি তোমাকে’ ও ‘বিয়ের ফুল’ ব্যাপক ব্যবসা সফল হয়। সালমান শাহের পর রিয়াজ-শাবনূর জুটি দর্শকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে।

২০০০ সালে শাবনূর-রিয়াজ জুটির ‘নারীর মন’ ও ‘এ মন চায় যে’ মুক্তি পায়। পরিচালনা করেন মতিন রহমান। এছাড়া এফ আই মানিক পরিচালিত ‘এ বাঁধন যাবে না ছিঁড়ে’, জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘নিঃশ্বাসে তুমি বিশ্বাসে তুমি’, সাঈদুর রহমান সাঈদ পরিচালিত ‘এরই নাম দোস্তি’, এফ আই মানিক পরিচালিত ‘ফুল নেবে না অশ্রু নেবে’ নায়ক ছিলেন শাকিব খান ও ইস্পাহানি আরিফ জাহান পরিচালিত ‘গোলাম’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

পরবর্তীতে ২০০১ সালে আবারও দেখা মেলে রিয়াজ-শাবনূর জুটির। এসময় তারা দর্শকদের উপহার দেন ‘শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ’। যেটি পরিচালনা করেন দেবাশীষ বিশ্বাস। একই বছর গাজী মাহবুব পরিচালিত ‘প্রেমের তাজমহল’ ও এফ আই মানিক পরিচালিত ‘স্বপ্নের বাসর’ ছবিগুলো তুমুল ব্যবসা করে। ২০০২ সালে গুণী নির্মাতা আমজাদ হোসেন পরিচালিত ‘সুন্দরী বধূ’, এফ আই মানিক পরিচালিত ‘হৃদয়ের বন্ধন’ ও ‘স্বামী স্ত্রীর যুদ্ধ’, জাকির হোসেন রাজু পরিচালিত ‘মিলন হবে কত দিনে’ ও ‘ভালোবাসা কারে কয়’, শাহাদৎ হোসেন লিটন পরিচালিত ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’ এবং আজাদী হাসনাত ফিরোজ পরিচালিত ‘সবার উপরে প্রেম’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন শাবনূর।

২০০৩ সালে অভিনয় করেন মতিন রহমান পরিচালিত ‘মাটির ফুল’, এফ আই মানিকের ‘দুই বধূ এক স্বামী’, আমজাদ হোসেনের ‘প্রাণের মানুষ’, আজাদী হাসনাত ফিরোজের ‘বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ’, জিল্লুর রহমানের ‘স্বপ্নের ভালোবাসা’, মহম্মদ হান্নানের ‘নয়ন ভরা জল’ ছবিতে। ২০০৪ সালে এই নায়িকা কাজী হায়াৎ পরিচালিত ‘অন্য মানুষ’, আজাদী হাসনাত ফিরোজের ‘ফুলের মতো বউ’, মিজানুর রহমান খান দীপুর ‘যত প্রেম তত জ্বালা’, শিল্পী চক্রবর্তীর ‘তোমার জন্য পাগল’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে শাবনূর অভিনীত সিনেমার মধ্যে আমজাদ হোসেনের ‘কাল সকালে’, সালাউদ্দিন লাভলুর ‘মোল্লা বাড়ীর বউ’, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘দুই নয়নের আলো’ এবং ‘আমার স্বপ্ন তুমি’। ‘দুই নয়নের আলো’ ছবিতে অসাধারণ অভিনয়ের জন্য শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী বিভাগে ক্যারিয়ারের প্রথম ও একমাত্র জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান শাবনূর।

২০০৬ সালে শাবনূর কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস ‘জনম জনম’ অবলম্বনে নির্মিত ‘নিরন্তর’ ছবিতে অভিনয় করেন। পরিচালনা করেন আবু সাইয়ীদ। ২০০৭ সালের মুক্তি পায় মালেক বিশ্বাস পরিচালিত ‘মেয়ে সাক্ষী’, মহম্মদ হান্নান পরিচালিত ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’ এবং পি এ কাজল পরিচালিত ‘আমার প্রাণের স্বামী’।

এরপর ২০০৮ সালে পি এ কাজলের ‘১ টাকার বউ’ ছবিতে শাকিব খানের সঙ্গে জুটিবদ্ধ হন শাবনূর। এই ছবিটিও ব্যবসা সফল হয়েছিল। ২০০৯ সালে রিয়াজের বিপরীতে মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত ‘তুমি আমার স্বামী’, এটিএম শামসুজ্জামান পরিচালিত ‘এবাদত’ ও আব্দুল মান্নান পরিচালিত ‘মন বসে না পড়ার টেবিলে’ এবং শাকিব খানের বিপরীতে পি এ কাজল পরিচালিত ‘স্বামী স্ত্রীর ওয়াদা’ ও শাহ মোঃ সংগ্রাম পরিচালিত ‘বলবো কথা বাসর ঘরে’ ছবিতে অভিনয় করেন এই নায়িকা। ২০১০ সালে শাবনূর অভিনয় করেন মনতাজুর রহমান আকবরের ‘এভাবেই ভালোবাসা হয়’, মোহাম্মদ হোসেনের ‘চাঁদের মত বউ’, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘মন ছুঁয়েছে মন’, চন্দন চৌধুরীর ‘ভালোবেসে বউ আনব’ এবং বি আর চৌধুরীর ‘বধূ তুমি কার’ ছবিতে।

শাবনূরের পারিবারিক নাম কাজী শারমিন নাহিদ নুপুর। গুণী চলচ্চিত্র নির্মাতা এহতেশাম তার নাম বদলে রাখেন শাবনূর। জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থাকাবস্থায় ২০১১ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্যবসায়ী অনিক মাহমুদের সঙ্গে আংটি বদল হয় শাবনূরের। ২০১২ সালের ২৮ ডিসেম্বর বিয়ে করেন তারা। এরপর মিডিয়াকে আড়াল করে অস্ট্রেলিয়ায় বসবাস শুরু করেন শাবনূর। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর ছেলে সন্তানের মা হন তিনি। তার ছেলের নাম আইজান নিহান।

২০১৩ সালে শাবনূর অভিনীত ‘কিছু আশা কিছু ভালোবাসা’ ছবিটি মুক্তি পায়। ওই ছবিতে তার সহশিল্পী ছিলেন ফেরদৌস ও মৌসুমী। পরিচালনা করেন মোস্তাফিজুর রহমান মানিক।

দীর্ঘদিন ধরে নতুন কোনও সিনেমায় কাজ না করলেও শাবনূরের জনপ্রিয়তার কোনও ভাটা পড়েনি। আজো নির্মাতারা শাবনূরকে নায়িকা করে সিনেমা বানাতে চান। যতদিন দেশীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি থাকবে, বেঁচে থাকবেন শাবনূর তার কর্মের গুণে।

About binodon

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *