মেরিন ড্রাইভ সড়কের মধ্য দিয়ে কক্সবাজার-টেকনাফের দূরত্ব যেমন কমেছে তেমনি সমুদ্র তীরকে করেছে নয়নাভিরাম। সড়কটি দিয়ে চলা শুরু করলে মনে অন্যরকম আনন্দ জাগে।
প্রকৃতির অ’পরূপ সৌন্দর্যের লীলায় মেরিন ড্রাইভ ঘিরে বিকশিত হচ্ছে পর্যটন শিল্প। ফলে কলাতলী ছাড়িয়ে সড়কটির পাশ ধরে ধীরে ধীরে টেকনাফ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে পর্যটনসেবী তারকা-নন তারকা প্রতিষ্ঠান।
এতে বিদেশের পরিবর্তে কক্সবাজারকে প্রথম পছন্দের তালিকায় রাখছেন ভ্রমণপ্রে’মীরা। বছরে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয় হওয়ায় পর্যটন শিল্প বিকাশে এক দশক ধরে নানামুখী কর্মসূচি পালন করছে সরকার।
পর্যটন ঘিরে গড়ে উঠছে গভীর সমুদ্রবন্দর, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামসহ নানা উন্নয়ন কর্মকা’ণ্ড। পর্যটন বর্ষসহ নানা উদ্যোগে দিনদিন কক্সবাজারে বিশ্বমানের পর্যটন বিকশিত হওয়ায় বাঁকা চোখে দেখে প্রতিবেশী অনেক দেশ।
কক্সবাজারের পর্যটনকে কলুষিত করতে গো’পনে কাজ শুরু করে বিদেশি চক্র। এজন্যই বিদেশি চক্রের দোসর হয়ে দৃষ্টিনন্দন মেরিন ড্রাইভ সড়কটিকে ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ জোন বানিয়ে বিকশিত পর্যটনকে বাধাগ্রস্ত করার পরিকল্পনায় হাঁটছিলেন টেকনাফ থা’না পু’লিশের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমা’র দাশ- এমন অ’ভিযোগ পর্যটনসেবীদের।
চলমান সময়ে মেরিন ড্রাইভ সড়কটি পর্যটনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ভ্রমণে আসা পর্যট’করা সড়কটিতে পা না ফেলে যান না। কিন্তু বিগত বছর দুয়েক ধরে সড়কটি ‘ক্রসফায়ার জোন’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভা ও অন্য প্ল্যাটফর্মে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে সড়টিকে মুক্ত রাখার দাবি তোলা হলেও কেউ কানে তোলেননি। ফলে পর্যট’কদের মাঝে বেড়ে যায় আতঙ্ক। সেই সঙ্গে সড়কটিতে কমে যায় পর্যট’কদের পদচারণা।
২০১৮ সালের ১৯ অক্টোবর টেকনাফ থা’না পু’লিশের ভা’রপ্রাপ্ত কর্মক’র্তা (ওসি) হিসেবে প্রদীপ কুমা’র দাশের যোগদানের পর থেকে মেরিন ড্রাইভ সড়ক আতঙ্কের জোনে পরিণত হয়। দুই বছরে এই সড়কে ‘ক্রসফায়ারে’ শতাধিক ব্যক্তি নি’হত হয়েছেন।
মা’দক নির্মূলের নামে ‘ক্রসফায়ারে’ মানুষ হ’ত্যা করা ছিল ওই এলাকার নিত্যদিনের ঘটনা। এই উন্মাদনা থেকে বাঁচতে পারেননি সে’নাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানও।
পু’লিশ সূত্রে জানা যায়, ২২ মাসে টেকনাফে ১৪৪টি ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২০৪ জন মা’রা গেছেন। তাদের অর্ধেকের বেশি লা’শ পড়েছিল মেরিন ড্রাইভে। যারা মা’রা গেছেন তাদের পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে।
যাকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হতো ১০-১২ দিন তাকে থা’না হাজতে রাখা হতো। আবার মাসের পর মাস থা’না হাজতে রাখার ঘটনাও ঘটেছে। এই সময়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার আশ্বা’সে ওই ব্যক্তির পরিবার-পরিজনের কাছ থেকে আদায় করা হতো লাখ লাখ টাকা। তবে শেষরক্ষা হয়নি অনেকের।
টেকনাফ উপজে’লা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুরুল বশর বলেন, টাকার নে’শায় ম’রিয়া ওসি প্রদীপের মতো এমন পু’লিশ কর্মক’র্তা জীবনেও দেখিনি। ‘ক্রসফায়ারের’ নামে মানুষ খু’ন করা ছিল তার নে’শা।
টেকনাফ থেকে ওসি প্রদীপ ২০০ কোটি টাকার অধিক নিয়েছেন। টেকনাফ থা’নায় ওসি প্রদীপের ডানে-বামে থাকা পাঁচ-ছয়জন ও টেকনাফের স্থানীয় কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই ওসি প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার’ ও চাঁদাবাজির রোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে আসবে।
টেকনাফের গুদারবিল এলাকার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য আবু ছৈয়দ এবং সাবরাংয়ের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আছারবনিয়ার ইউপি সদস্য শরিফ প্রকাশ শরিফ বলি ছিলেন ওসি প্রদীপের অ’পকর্মের সহযোগী। প্রদীপের টাকায় মিয়ানমা’র থেকে চো’রাইপথে গরু এনে টেকনাফ হয়ে চট্টগ্রামে নিয়ে বিক্রি করা হতো। ভাগের টাকা চট্টগ্রামে বুঝে নিতেন প্রদীপের লোকজন। অধিকাংশ ‘ক্রসফায়ারের’ চাঁদাবাজির টাকাও এই দুই মেম্বারের হাতে যেতো। অন্য টাকা নিতেন প্রদীপের বডিগার্ড কনস্টেবল সাগর। এভাবে ‘বর্ণচো’রার’ মতো চলেছে প্রদীপের ‘ক্রসফায়ার’ বাণিজ্য।
‘ক্রসফায়ারের’ ভ’য় দেখিয়ে আ’ট’ক ব্যক্তির পরিবার থেকে লুটে নেয়া হতো স্বর্ণালঙ্কার। তা বিক্রি করা হতো চট্টগ্রামের স্বর্ণ মহাজন সজল ধরের কাছে। তার কাছে যেত লুণ্ঠিত সব ধরনের স্বর্ণালঙ্কার।
প্রদীপের টেকনাফে স্থানীয় সহযোগীর মাঝে অন্যতম হিসেবে নাম এসেছে টেকনাফ কমিউনিটি পু’লিশের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক নুরুল হোসাইনের। পু’লিশের হাতে আ’ট’ক ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যদের ভ’য়ভীতি দেখিয়ে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন তিনি।
২৭ জুলাই সেন্টমা’র্টিন থেকে আ’ট’ক মাছ ব্যবসায়ী জুবায়েরকে ‘ক্রসফায়ার’ থেকে বাঁ’চানোর কথা বলে দুই দফায় ১০ লাখ টাকা নেন নুরুল হোসাইন ও আবদুল কাইয়ুম নামে দুই ব্যক্তি। এরপরও জুবায়ের ছাড়া পাননি।
অবশেষে তাকে মা’মলার আ’সামি করেন ওসি প্রদীপ। মা’মলায় জড়ানোর পর টাকা ফেরত পেতে সহযোগিতা চেয়ে টেকনাফের ইউএনও এবং বিশেষ এক গোয়েন্দা শাখার কাছে লিখিত অ’ভিযোগ দেন জুবায়েরের ভাই ইউনুস।
নিজের আওতাধীন এলাকা না হওয়া সত্ত্বেও গত ২৪ জুলাই রাতে উখিয়ার কুতুপালং থেকে ইউপি সদস্য মোলভী বখতিয়ারকে ধরে নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। তার সঙ্গে নিয়ে যান রোহিঙ্গা তাহের নামে আরেকজনকে। রাতে এসে বখতিয়ার মেম্বারের বাড়িতে ভাঙচুর চালিয়ে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ ৫০ টাকা নিয়ে যান ওসি প্রদীপ। পরে ‘ক্রসফায়ারে’ না দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তার ছে’লে হেলাল থেকে নেয়া হয় আরও ২৭ লাখ টাকা।
জমি-মা’র্কেট বন্ধক রেখে চাহিদা মতো টাকা দেয়া হলেও পরদিন দুইজনকে ‘ক্রসফায়ারে’ হ’ত্যা করেন ওসি প্রদীপ। এ ঘটনায় করা মা’মলায় বখতিয়ারের ঘর থেকে নগদ ১০ লাখ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উ’দ্ধারের গল্প সাজানো হয়। এসব তথ্য একটি বিশেষ সংস্থার কাছে দেয়া জবানব’ন্দিতে উল্লেখ করেছেন মৌলভী বখতিয়ারের স্ত্রী’।
স্থানীয় সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপের ৫-৬ জন সহযোগী রয়েছেন। তাদের জন্য রাখা রাখা ছিল কয়েকটি মাইক্রোবাস। এসব গাড়ি নিয়ে একেকজন রাতে বেরিয়ে পড়েন। স্থানীয় লোকজনকে আ’ট’ক করে রাতে থা’নার তিনতলার টর্চার সেলে নিয়ে যেতেন। টর্চার সেলে দাবি’কৃত টাকা না পেলে তার ভাগ্যে নেমে আসত মেরিন ড্রাইভের সাজা। সাজানো হতো ‘ক্রসফায়ারের’ নাট’ক। পরে একেকটি মা’মলায় ২০-২৫ জনকে আ’সামি করা হতো। এভাবে টেকনাফের মানুষকে জি’ম্মি করে রাখেন ওসি প্রদীপ। আ’ট’ক ব্যক্তিকে থা’নায় এনে মা’রধর করে ইয়াবা, অ’স্ত্র ও গু’লি দিয়ে ছবি ও ভিডিও ধারণ করে বিভিন্ন জনের নাম বলাতেন ওসি প্রদীপ। সেই সঙ্গে টার্গেট করে টাকা আদায় ও ‘ক্রসফায়ারের’ নাট’ক সাজাতেন তিনি।
এমনও ঘটনা রয়েছে থা’নায় মা’মলা হয়েছে অথচ আ’সামি কিছুই জানেন না। পরে মা’মলায় আ’সামি হওয়ার কথা শুনে অনেকে অ’সুস্থ হন। কেউ কেউ চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এসব ঘটনা কাউকে জানানোর সাহসও করেননি তারা।
ভুক্তভুগী সাবরাং কা’টাবনিয়ার কামাল হোসন বলেন, গত বছরের ৭ জানুয়ারি টেকনাফ থা’নার এএসআই সজিব দত্ত আমা’র ভাই আবুল কালামকে আ’ট’ক করে থা’নায় তিনদিন আ’ট’কে রাখেন। পরে আমা’র মা জ’রিনা খাতুন অনেক অনুরোধ করে এএসআই সজিব দত্তের সঙ্গে পাঁচ লাখ টাকায় ছেড়ে দেয়ার চুক্তি করেন। মা নিজ হাতে সজিবকে পাঁচ লাখ ২০ হাজার টাকা দেন। ১০ জানুয়ারি সকালে আমা’র ভাইকে ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়া হয়। টাকা দেয়ার পরও রক্ষা পায়নি আমা’র ভাই। পরে এএসআই সজিবের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিন লাখ টাকা ফেরত দেন। বাকি টাকা এখনও দেননি।
তিনি বলেন, আমা’র ভাই কালাম ‘ইয়াবার গডফাদার’ ছিল না, অথচ ‘ক্রসফায়ারে’ দেয়ার পর তাকে গডফাদার বলা হলো। তার বি’রুদ্ধে মা’দকের কোনো মা’মলা ছিল না। হ’ত্যার পর তার নামে মা’দকের মা’মলার কথা বলা হলো। জমিজমা নিয়ে মা’রামা’রির মা’মলা ছিল তার বি’রুদ্ধে। অথচ ‘ক্রসফায়ারে’ হ’ত্যার পর বলা হলো মা’মলা আছে মা’দকের। এসব মিথ্যা। আমি আমা’র ভাই হ’ত্যার বিচার চাই।
প্রদীপের সহযোগীদের হাতে টেকনাফের আওয়ামী লীগ নেতা হামজালাল মেম্বারও আ’ট’ক হয়েছিলেন। গত বছরের ২৩ জানুয়ারি তাকে আ’ট’ক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভ’য় দেখিয়ে ছয় লাখ ৩০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। পরে তাকে তিন হাজার ইয়াবা দিয়ে আ’দালতে চালান দেয়া হয়।
একই ভাবে টেকনাফ সদরের পল্লান পাড়ার আবদু শুক্কুর বিএকে আ’ট’ক করে ‘ক্রসফায়ারের’ ভ’য় দেখিয়ে চার লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর মুফতি জাফরের কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার সরওয়ারের কাছ থেকে ছয় লাখ টাকা, ওম’র হাকিম মেম্বারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা, ছোট হাবির পাড়ার মহিউদ্দীনের কাছ থেকে সাড়ে চার লাখ টাকা, ইস’লামাবাদের নেজাম থেকে দুই দফায় নয় লাখ টাকা, মিঠাপানির ছড়ার মো. তৈয়ুবের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা ও রাজার ছড়ার মৌলভী আব্দুল হামিদের কাছ থেকে দুই দফায় ১৫ লাখ টাকা নেন ওসি প্রদীপ।
শীলবনিয়া পাড়ার অস্ট্রেলিয়া প্রবাসীর বাড়ি নির্মাণে বাধা দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা, মাঠপাড়ার মোহাম্ম’দ হোছন থেকে ৪০ লাখ টাকা, উত্তর লম্বরী ফিরোজ মিয়ার কাছ থেকে চার লাখ টাকা, উত্তর লম্বরী জামালের কাছ থেকে সাড়ে তিন লাখ টাকা, উত্তর লম্বরীর সৈয়দ মিয়ার থেকে পাঁচ লাখ টাকা, দক্ষিণ ল্গেুরবিলের এনামের কাজ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, সদর চেয়ারম্যান শাহ’জাহান থেকে ২৫ লাখ টাকা, সেন্ট মা’র্টিন পূর্বপাড়ার আজিমের কাছ থেকে সাত লাখ টাকা, শাহপরীর দ্বীপ বাজারপাড়ার ইসমাইলের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা, উপজে’লা আওয়ামী লীগ নেতা সাবরাং মন্ডলপাড়ার এজাহার মিয়ার কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকা, একই এলাকার জামালের কাছ থেকে চার লাখ টাকা, ল্গেুর বিল এলাকার ইউনুস থেকে সাত লাখ টাকা নেন প্রদীপ। টাকা নিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ না দিয়ে কমবেশি ইয়াবা দিয়ে আ’দালতে এদের চালান দেন তিনি।
টেকনাফ থা’না পু’লিশের সাবেক ওসি প্রদীপ কুমা’র দাশের বি’রুদ্ধে ওঠা এসব অ’ভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজারের পু’লিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও রিসিভ করেননি তিনি।