এক সময় বুনো এক গাছের বাকলই হয়ে উঠেছিল ম্যালেরিয়া রো’গের ওষুধের উৎস, যা বর্তমানে প্রায় বিপ’ন্ন এক গাছ। পেরুর আন্দিজ রেইনফরেস্ট অঞ্চলের গ’ভীর থেকে আহরিত হতো এ গাছটি। এখন বিশ্বব্যাপী মহাবিত’র্কের কে’ন্দ্রে থাকা ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন এই বৃক্ষজাত।






মশাবাহিত ম্যালেরিয়া শতাব্দীর পর শতাব্দী বিশ্বব্যাপী মানুষকে ভুগিয়েছে। এটি রোমান সাম্রাজ্যকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছিল। বিংশ শতকেও প্রা’ণ কেড়ে নিয়েছিল ১৫ থেকে ৩০ কোটি মানুষের। এতো মানুষের মৃ’ত্যুতে বিশ্বের মানচিত্রই বদলে গিয়েছিল। বিশ্ব স্বা’স্থ্য সংস্থার মতে, এখন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ যেখানে বসবাস করে সেখান এক সময় ভ’য়াবহ দাপট দেখিয়েছে ম্যালেরিয়া।






দক্ষিণ-পশ্চিম পেরুর যে অঞ্চলে আন্দিজ ও আমাজনের অববাহিকা মিলিত হয়েছে সেখানেই সবুজে’র গালিচার ওপর ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন হেক্টর জায়গা নিয়ে মানু ন্যাশনাল পার্ক। এর আশেপাশের আরো বহুদূ’র পর্যন্ত প্রকৃতির এক রহ’স্যময় অঞ্চল, যেখানে অনেক জায়গায় হয়তো কখনো মানুষের পদচিহ্নও প’ড়েনি। সেখানেই কোথাও কোথাও দেখা যায় প্রায় ১৫ মিটার লম্বাটে ‘সিনকোনা অফিসিনালিস’ গাছ।






আন্দিজ পর্বতের পাদদেশের মানুষের কাছে এটি খুবই পরিচিত এক গাছ। এটি ঘিরে রয়েছে অনেক রূপকথা। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধ’রে মানুষের ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে বৃক্ষটি। পেরুভিয়ান আমাজন অঞ্চলের মাদ্রে দে দিওস অঞ্চলে জ’ন্ম ও বেড়ে ওঠা নাতালি ক্যানালেস বর্তমানে ডেনমা’র্ক ন্যাশনাল মিউজিয়ামের জীববিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করছেন। সিনকোনা গাছ নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা হয়তো খুব সুপরিচিত গাছ নয়। কিন্তু এ গাছের উপাদানে তৈরি একটি মি’শ্রণ মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।’






সিনকোনা গাছের জে’নেটিক ইতিহাস খুঁজে চলেছেন ক্যানালেস জা’নান, এ গাছের বাকল থেকেই বিশ্ব প্রথম পায় কুইনাইন, যা ম্যালেরিয়ার প্রথম ওষুধ হিসেবে সমাদৃত। কুইনাইনের আবিষ্কার নিয়ে বিশ্বজুড়ে শিহ’রণ যেমন ছিল, তেমনি ছিল স’ন্দে’হও। এ গাছ থেকে কাঁচামাল নিয়ে উৎপাদিত ওষুধ হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে এখন তুলকালাম চলছে।






তিনি আরও জা’নান, মা’র্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রা’ম্প ম্যালেরিয়ার এ ওষুধকে নভেল করো’না ভা’ই’রাসের জন্য কা’র্যকর ওষুধ হিসেবে ঘো’ষণা দিয়েছেন এবং তিনি প্রতিদিন একটি করে হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন সেবন করেন বলেও জা’নিয়েছেন। এমনকি এই ওষুধটির জন্য তিনি ভা’রতকে হু’মকিও দিয়েছেন, কারণ ভা’রতেই এর উৎপাদন সবচেয়ে বেশি। যদিও স’ম্প্রতি বিশ্ব স্বা’স্থ্য সংস্থা ঘো’ষণা দিয়েছে, কভিড-১৯ রো’গের জন্য হাইড্রোক্সিক্লোরোকুইন ব্যবহার নি’রাপদ নয়।






উনিশ শতকে বিশ্বজুড়ে ইউরোপীয় কলোনিগুলোয় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ বাড়তে থাকলে সিনকোনার চাহি’দাও বাড়তে থাকে। ‘ম্যালেরিয়া সাবজেক্টস’ বইয়ের লেখক ড. রোহান দেব রায় জা’নান, বিশ্বকে শাসন করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে কুইনাইন মজুদ করাটা সে সময় বেশ গু’রুত্ব পূর্ণ হয়ে ওঠে। সিনকোনার ছাল হয়ে ওঠে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান পণ্য।






দেব রায় বলেন, কলোনিয়াল যু’দ্ধে ইউরোপিয়ান সৈ’ন্যরা হরহামেশাই ম্যালেরিয়ায় মা’রা যেত। বিশেষ করে ট্রপিক্যাল অঞ্চলের কলোনিতে টিকে থাকা ও যু’দ্ধে জয়লাভের ক্ষেত্রে সৈ’ন্যদের সাহায্য করেছে কুইনাইন।
দেব রায়ের মতে, ডাচরা ইন্দোনেশিয়ায়, ফরাসিরা আলজে’রিয়ায় এবং ব্রিটিশরা ভা’রত, জ্যামাইকা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম আফ্রিকায় সিনকোনা ব্যবহার করেছে। ১৮৪৮ থেকে ১৮৬১ সালের মধ্যবর্তী সময়ে ব্রিটিশরা বর্তমান বিনিময় হারের হিসাবে তখন প্রতি বছর ৬৪ লাখ পাউন্ড ব্যয় করে সৈ’ন্যদের জন্য সিনকোনা আম’দানি করতো। এ কারণে কুইনাইনকে অনেক ইতিহাসবিদ ‘সাম্রাজ্যবাদের অ’স্ত্র’ হিসেবে দেখছেন, যে অ’স্ত্র ব্যবহার করে দুনিয়াজোড়া বিস্তৃতি লাভ করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য।
কিংবদন্তি বলে, ১৬৩১ সালে ম্যালেরিয়ার প্রতিষেধক হিসেবে কুইনাইন আবিষ্কার হয়। তখন পেরুর ভাইসরয়ের স্প্যানিশ স্ত্রী’ কাউন্টেস অব সিনকোনা প্রচ’ণ্ড জ্বরে আক্রা’ন্ত হন, পাশাপাশি তার শ’রীর মাঝে মধ্যে ঠাণ্ডা হয়ে যেত; যা কিনা ম্যালেরিয়ার মূল উ’পসর্গ। তাকে সু’স্থ করে তুলতে ম’রিয়া ভাইসরয় স্ত্রী’কে জেসুইট পাদ্রীদের দেয়া একটি ওষুধ খাওয়ান, যা তৈরি হয় আন্দিজ অঞ্চলের বিশেষ একটি গাছ, লবঙ্গ, গো’লাপ পাতার সিরাপ ও অন্যান্য কিছু গাছের উপাদান দিয়ে। এ ওষুধটি খেয়ে সু’স্থ হয়ে ওঠেন ভাইসরয়-পত্নী এবং অলৌকিকভাবে তাকে বাঁচিয়ে দেয়া এ গাছটির নামকরণ করা হয় তার সম্মানেই: সিনকোনা। আজ এটি পেরু ও একুয়েডরের জাতীয় বৃক্ষ।