Breaking News

বাসর রাত তাই চিৎকার করেনি ‘ফুলি’

সময় রাত ২টা ৪৫ মিনিট। ডিউটি ডাক্তার সবে মাত্র বিশ্রাম নেয়ার জন্য ঘুম ঘুম চোখে বিছানায়। ই’মা’রজেন্সি থেকে কল আসল। চোখের পাতায় ঘুম ঠেসে, ই’মা’রজেন্সিতে এসে চ’মকে যাওয়ার মত অবস্থা।

মহিলা রোগী, পরনের চাদর র’ক্তে ভেজা। মুখের রঙ ফ্যাকাসে, সাদা। কাপড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে নতুন বিয়ে হয়েছে। রোগীর নাম ফুলি (ছদ্দ নাম)। হিষ্ট্রি নেয়ার জন্য ডাক্তার জানতে চাইল, কি হয়েছে? রোগীর সাথে সদ্য বিবাহিত জামাই, জা এবং আরও ৪/৫ জন এসেছে।

ডাক্তারের প্রশ্ন শুনেই রোগীর বর চো’রের মত, রুম থেকে বের হয়ে গেল। রোগীর সঙ্গে আসা এক মহিলা তেজের সাথে বলল, ‘ডাক্তার হইছেন, বুঝেন না কেরে, সব বলতে হইবো!’ ওদের গ্রামে গাছের মা’থায় বাধা মাইকটিতে একটির পর একটি বিয়ের গান বেজে চলছে।

বিয়ে বাড়িতে সবাই ব্যস্ত। বর পক্ষের যারা এসেছে, কথা বার্তায় অ’ভিজাত ও ব্যক্তিত্ব দেখানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। দর কষাকষি করার পরে, কনে পক্ষ থেকে যৌতুক হিসেবে যা পাওয়া গেছে, তা নেহাতই কম নয়। কিন্তু কম হয়ে গেছে কনের বয়স।

বাচ্চা মে’য়ে, নাম ফুলি, সবে মাত্র ১৪ পেরিয়ে ১৫ বছরে পড়েছে। মে’য়ের বাবাও মোটামুটি ভাবে লাল শাড়ি পড়িয়ে মে’য়েকে বিদায় দিতে পেরে খুশি। মে’য়ে হলে তো বিদায় দিতেই হবে। ক্লাস সেভেন পর্যন্ত মে’য়েকে পড়িয়েছে। কম কি!

তাছাড়া, শোনা যাচ্ছে ছে’লেও নাকি ভাল। বাড়ির উঠোনে বসে মুখে পান চিবোতে চিবোতে ছে’লের মামা বলল, ‘এমন ছে’লে কোথায় পাবেন মিয়া। তাছাড়া, ছে’লে মানুষের একটু দোষ থাকলেও সমস্যা নেই, বিয়ের পর ঠিক হয়ে যাবে।’

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে মে’য়েকে নিয়ে আসা হল তার নতুন ঘরে। যে মে’য়েটি সবে মাত্র জীবনের সংজ্ঞা শিখতে শুরু করেছে, শৈশব থেকে কৈশোরে পা রাখতে যাচ্ছে, কিছু বুঝে ওঠার আগেই, তার আজ বাসর রাত। পুরুষতান্ত্রিক এই সমাজে সতীত্ব যাচাই করার উৎসব।

আর বিয়ে তো একটি সামাজিক বৈধতা মাত্র। সমাজ অনেক এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু বিয়ের সময় মে’য়ের মতামতটা এখনও গৌন। মে’য়ের যদি মতামত না নেওয়া হয় বা পরিবারের কারও ধমকে মতামত দানের পর বিয়ে হয়, তাহলে তাকে ধ’র্ষণ না বলে উপায় নেই।

ফুলির ইচ্ছে করছে, চি’ৎকার করতে, কিন্তু বাসর ঘরে চি’ৎকার করা যে উচিত নয়, এতটুকু বুঝতে শিখেছে ফুলি। হাত পা ছুঁড়ে বরের লালসার যজ্ঞ থেকে বেরিয়ে আসার মি’থ্যে চেষ্টা। সমাজ বিধীত ‘বর’, যখন আদিম পশুত্ব থেকে বাস্তবে ফিরে আসে, তখন ফুলি র’ক্তে ভেজা।

তখনও ফিনকির মত র’ক্ত যাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে সাদা ফাক্যাসে হয়ে আসছে মুখের রঙ!ফুলি এখন হাসপাতা’লের বেডে অচেতন হয়ে শুয়ে আছে। তাকে যখন হাসপাতা’লে নিয়ে আসা হচ্ছে, ফুলির চোখ পড়েছিল শ্বশুরবাড়ির লোকজনের ওপর। তারা যে কানাকানি করে কথা বলছিল, ব্যাঙ্গাত্তক হাসি তামাশা করছিল। যেন সব দোষ ফুলির।

লজ্জায় কারও দিকে তাকাতেও ভ’য় করে। তারপর ইঞ্জিন চালিত গাড়ীর প্রচন্ড শব্দ। আরও এলোমেলো কিছু মুহূর্ত। কিছুক্ষণ পর, সাদা এপ্রোন পড়া একজন ডাক্তার এসে তার হাত ধরেছে। মনে আছে শুধু এটুকুই।ডাক্তার নার্সকে সাথে নিয়ে, ফুলিকে পরীক্ষা করলেন। ভ’য়াবহ রকমের পেরিনিয়াল টিয়ার (যৌ’নাঙ্গ ও তার আশ পাশ ছিঁড়ে গেছে)। তখনও র’ক্ত যাচ্ছে প্রচুর।

হাতে পালস দেখা হল। খুবই কম। জরুরি ভিক্তিতে রোগীকে র’ক্ত দেয়া দরকার। জরুরি অবস্থায় অ’পারেশন করে ছিঁড়ে যাওয়া অংশ ঠিক করতে হবে।এই ভ’য়াবহ সংকটাপন্ন রোগীকে নিয়ে হিমসিম খাওয়ার অবস্থা কর্তব্যরত ডাক্তারের। ম্যাডামকে ফোন করা হল, প্রাথমিক ভাবে ম্যানেজ করার জন্য র’ক্ত দরকার। রোগীর সাথে যারা এসেছে এতক্ষণ ই’মা’রজেন্সি রুমের সামনে চিল্লা পাল্লা করছিল। ডাক্তার এসে জানালো জরুরি ভিক্তিতে র’ক্ত দরকার। তখন সবাই চুপ। কেউ কেউ কে’টে পড়ার জন্য পাশে সরে গেল।

কিছুক্ষণ পর রোগীর লোক জানালো, তারা র’ক্ত জোগাড় করতে পারবে না। যা হয় হবে!ডাক্তার তাদের বুঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু লাভ হল না…রাত সাড়ে তিনটায় ম্যাডাম আসলেন। তার ধমকে শেষ পর্যন্ত তারা র’ক্ত জোগাড় করতে রাজি হল। কিন্তু র’ক্ত আর সেই রাতে জোগাড় হল না।অ’পারেশন থিয়েটারে ফুলিকে নিয়ে গিয়ে টিয়ার রিপেয়ার করা হল।সকালে রোগীর শ্বশুরবাড়ির লোক সবাই উধাও। ফুলির বাবা আসলেন সেই ভোরে, র’ক্ত জোগাড় হল কোন রকমে। ছয়দিন পর, রোগীর সেপ্টিসেমিয়া ডেভলপ করলো।

ইনফেকশন র’ক্তে ছড়িয়ে গেছে। ভাল অ্যান্টিবায়োটিক দরকার।রোগীর বাবা এসে বললেন, তার আর খরচ চালানোর সাম’র্থ্য নাই, বিয়েতেই অনেকগুলো টাকা ঋণ করে খরচ করতে হয়েছে।ডাক্তার পরাম’র্শ দিলেন, কোন সরকারি হাসপাতা’লে ভর্তি করাতে, তাহলে ঔষুধ কেনার খরচ কিছুটা বাচবে। কিন্তু, হাসপাতাল মানে তো, কাজকর্ম রেখে একজনকে রোগীর পাশে থাকতে হবে।

রিলিজ দিয়ে বাসায় নিয়ে যেতে চাচ্ছেন, যা হবার হবে।রিলিজ নিয়ে ফুলিকে বাসায় নেয়া হল। আরও বেশি অ’সুস্থ হওয়ায় চারদিন পরে আবার হাসপাতা’লে ভর্তি করা হল। পরদিন ভোর ভোর সময়। একবার চোখ খুলে আবার বন্ধ করলো ফুলি। সেই বন্ধ শেষ বন্ধ। এই সমাজের প্রতি ঘৃনায় চোখ জ্বল জ্বল করছিল কি না কেউ দেখতে পারেনি। ভোরের স্বল্প আলোয় বিদায় জানালো জীবনের নিষ্ঠুরতাকে!

ফুলি ‘একিউট রেনাল ফেইলরে’ মা’রা গেছে।ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে ডায়ালাইসিসের জন্য বলা হয়েছিল, এদিকে টাকার অভাব, তার উপর রোগী নিয়ে এত ঝামেলাও করতে পারবে না। শ্বশুরবাড়ি থেকে সেই বাসর রাতের পর, কেউ আসেনি। তাদেরই বা এত চিন্তা কি, একটা বউ ম’রলে দশটা বউ পাওয়া যায়!ফুলি একা নয়, এ রকম ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। এই ঘটনা গুলো চক্ষু লজ্জার ভ’য়ে প্রকাশ হয় না। কিন্তু সচেতনতা জরুরি।

About Utsho

Check Also

ভরিতে স্বর্ণের দাম বা’ড়লো ২৩৩৩ টাকা

ভরিতে স্বর্ণের দাম ২ হাজার ৩৩৩ টাকা বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতি …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *