দিনাজপুরের মে’য়ে ডা. সাবরিনা। বেড়ে ওঠেন ঢাকার শ্যামলীর পিসি কালচার রোডের নিজস্ব বাড়িতে। মাঝে বেশ কিছুদিন পরিবারের সঙ্গে দেশের বাইরে থাকার কারণে
পাশ্চাত্য জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিলেন তিনি।
১৯৯৩ সালে ঢাকার ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি পাস করেন সাবরিনা। এরপর এমবিবিএস পাস করেন সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ থেকে। এই কলেজে থাকাকালেই বেপরোয়া হয়ে ওঠেন এই প্রতারক চিকিৎসক।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ২২ ব্যাচের এই ছা’ত্রী বন্ধুদের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই মেতে উঠতেন ডিসকো আর ম’দের আড্ডায়। রাত-বিরাতে তাদের সঙ্গে ছুটে যেতেন লং ড্রাইভে। একপর্যায়ে ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করে ফেলেন সহপাঠীকে। তবে বেশি দিন টেকেনি সেই বিয়ে।
বন্ধুর সাথে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর বেশ কিছুদিন একা থাকেন সাবরিনা। পরবর্তী সময়ে তিনি বিয়ে করেন এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ীকে। সিই ঘরে সাবরিনার দুই সন্তান রয়েছে। কিন্তু সেই সংসারও বেশিদিন টেকেনি।
দ্বিতীয় সংসার ভাঙার পর আরিফকে বিয়ে করেন সাবরিনা। নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে সাবরিনার এক আত্মীয় জানান, ২০১৪ সালের দিকে আরিফ রোগী হিসেবে মোহাম্ম’দপুরের হু’মায়ুন রোডের বিডিএম হাসপাতা’লে ডা. সাবরিনার কাছে যেতেন।
বিডিএম হাসপাতা’লে প্রাইভেট চেম্বার করতেন ডা. সাবরিনা। সেখানে রোগী হিসেবে যাতায়াতের সুবাদে আরিফ নিজেকে প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ও ওভাল গ্রুপের সিইও পরিচয় দেন। স্বামীর সঙ্গে আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়ায় সাবরিনা তখন ছিলেন অনেকটা নিঃসঙ্গ।
সেই সুযোগ নেন আরিফ। সাবরিনার আগের সংসারে থাকা সন্তানদের দায়িত্বও নিতে রাজি হন আরিফ। ২০১৫ সালে বিয়ে করেন তারা। বিয়ের পর সাবরিনা-আরিফ দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়িয়েছেন। সেইসব ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ করেছেন।
সূত্রমতে, আরিফের সঙ্গে বিয়ের পর বেপরোয়া হয়ে ওঠেন সাবরিনা। দু’জনে দেশে-বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও ঠিকাদারি কাজ পেতে নানামুখী তদবির করেন সাবরিনা।
এক্ষেত্রে সাবরিনা বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) ও স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ (স্বাচিপ)-এর কয়েকজন নেতাকে কাজে লাগান বলেও অ’ভিযোগ রয়েছে।
জানা যায়, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতা’লের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের রেজিস্ট্রারের দায়িত্ব পালন করে আসা ডা. সাবরিনা জেকেজি হেলথকেয়ারের প্রধান নির্বাহী আরিফুল হক চৌধুরীর চতুর্থ স্ত্রী’ ছিলেন।
আরিফের এক স্ত্রী’ থাকেন রাশিয়ায়, অন্যজন লন্ডনে। আরেকজনের সঙ্গে তার ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। তবে ছাড়াছাড়ির পরও সাবেক ওই স্ত্রী’ উচ্চ’মহলে আরিফের জন্য দেনদরবার করে যাচ্ছেন।
দেশে মা’র্চের ৮ তারিখে করো’নার সংক্রমণ হওয়ার পর থেকে এই মহামা’রিকে কাজে লাগানোর চিন্তাভাবনা করছিলেন আরিফ-সাবরিনা। এরপর সাবরিনার হাত ধরেই করো’নার স্যাম্পল কালেকশনের কাজটি বাগিয়ে নেয় অখ্যাত জোবেদা খাতুন সর্বজনীন স্বাস্থ্য সেবা বা জেকেজি হেলথ কেয়ার নামের এই প্রতিষ্ঠানটি।
এপ্রিল মাসে দেশে করো’নাভাই’রাসের নমুনা পরীক্ষার জন্য অনুমতি পায় তারা। নমুনা পরীক্ষায় টেকনোলজিস্ট ও স্বেচ্ছাসেবকদের প্রশিক্ষণের জন্য তাদের রাজধানীর তিতুমীর কলেজে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপনের জায়গা করে দেয়া হয়।
১২ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ জেকেজির প্রস্তুতি দেখতেও যান তিতুমীর কলেজে। তিতুমীরে ছিলেন জেকেজির অন্তত ২০০ কর্মী।
জেকেজির কর্মীরা তিতুমীরে আসার পর শুরু থেকেই মা’দকের আখড়া গড়ে তোলেন। তাদের সহোযোগিতা করেন আরিফুল ও সাবরিনা। রাতে চলতো উচ্চশব্দে নাচ-গান। মু’সলিম প্রধান দেশেও তারা রমজানের কোনো বিধিনি-ষেধ না মেনে রোজার সময়ে কমপক্ষে দশটি সাউন্ড বক্স বাজিয়ে গানের সাথে সাথে নানান ভঙ্গিতে অ-শ্লী-ল নৃত্য প্রদর্শন করতো।
যা নিয়ে স্থানীয়রা কয়েকবার অ’ভিযোগ করলেও আরিফুলের ভাড়াটে ক্যাডারদের ভ’য়ে তারা কিছু করতে পারেননি। অ’ভিযোগ রয়েছে জেকেজির কথিত স্বাস্থ্যসেবা দিতে আসা মে’য়েরা অ-শা-লীন পোশাক পরে ঘুরে বেড়াতো।
তিতুমীরের ৪র্থ শ্রেণির কর্মক’র্তারা এ বিষয়ে একাধিকবার অ’ভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো তাদের ওপর হা’মলা চালায় আরিফুল চৌধুরীর ভাড়াটে ক্যাডার বাহিনী। সেই সব ঘটনা গণমাধ্যমেও আসে।
তিতুমীর কলেজের কর্মীরা যখন জেকেজির নানান অ’নৈতিক কর্মকা’ণ্ড দেখতে ও জানতে পারেন তখন তাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য কয়েকবার হু’মকি দেয়া হয়। এক পর্যায়ে তাদের মুখ বন্ধ করতে হা’মলার নির্দেশ দেন জেকেজির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা সাবরিনা।
তার নির্দেশ পেয়ে জেকেজির ক্যাডার বাহিনী ২ জুন রাত ২টার দিকে তিতুমীরের ৪র্থ শ্রেণির কর্মীদের ওপর হা’মলা চালায়। এরপর সাবরিনা এই হা’মলার ঘটনা সাজাতে গভীর রাতে সড়ক অবরোধ করে নানান ধরনের স্লোগান দেন এবং
পরদিন ক্যাম্পাসে সাংবাদিকরা সংবাদ সংগ্রহ করতে গেলে তাদের ওপরও হা’মলা চালানো নির্দেশ দেন সাবরিনা। চেয়ারম্যানের নির্দেশ পেয়ে সে সময় দুই সাংবাদিকের ওপর হা’মলা চালায় জেকেজির ক্যাডাররা।
এরপর ৩ জুলাই থেকে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রথমবারের মতো আলোচনায় উঠে আসে জেকেজি ও সাবরিনা। এরপর ১৫ জুন একটি অনলাইন পত্রিকায় জেকেজির দু’র্নীতির বিষয়টি উঠে আসে। পরে বেশ কয়েকজন ভুক্তোভোগী জেকেজির প্রতারণার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আনেন।
এরপর অ’ভিযান চালিয়ে ২৩ জুন (মঙ্গলবার) জেকেজি হেলথ কেয়ারের সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ পাঁচজনকে আ’ট’ক করে পু’লিশ। একে একে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করে। জানা যায়, জেকেজি হেলথ কেয়ারের কোনো ল্যাব বা পরীক্ষাগার ছিলো না। কম্পিউটারে ফলাফল লিখে ই-মেইলে তা রোগীর কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
আরিফুল হক চৌধুরী গ্রে’প্তারের পর থেকেই অ’ভিযোগ ওঠে তার স্ত্রী’ ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী জেকেজির সার্বিক কাজে শুরু থেকেই তাকে সহায়তা করে আসছিলেন।
সাবরিনা নিজে জানিয়েছেন তিনি তিতুমীরের স্বেচ্ছাসেবীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন যারা কিনা গ্রে’প্তার আ-তঙ্কে কলেজ ছেড়ে পালিয়েছেন। অ’ভিযোগ রয়েছে ভু’য়া পরীক্ষা সনদ দিতেন এসব কথিত স্বেচ্ছাসেবীরাও। আর তাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন সাবরিনা আরিফ।
এ সময় সাবরিনা দাবি করেন আরিফ চৌধুরী আর তার স্বামী নন। তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়েছেন সাবরিনা। দুই মাসের মধ্যে সেটা কার্যকর হবে। এর মাঝে নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের নাম পরিবর্তন করেন সাবরিনা।
আগে তার নাম ‘সাবরিনা আরিফ চৌধুরী’ থাকলেও স্বামী জে’লে যাওয়ার পর পরই তিনি তা বদলে করেন ‘সাবরিনা মিষ্টি চৌধুরী’। একই সাথে তিনি নিজের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে স্বামীর সাথে থাকা সব ছবি মুছে ফেলেন।
বেশ কিছু বিষয়ে ত’দন্তের পর ১২ জুলাই (রোববার) সাবরিনাকে গ্রে’প্তার করে পু’লিশ। পরে তাকে সোমবার ঢাকার মহানগর হাকিম শাহিনুর রহমানের আ’দালতে হাজির করা হলে তিন দিনের রি’মান্ড মঞ্জুর করা হয়।
রি’মান্ডের প্রথম’দিনে সাবরিনা জিজ্ঞাসাবাদে প্রতারণার মাধ্যমে জেকেজিকে কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তবে, তিনি যে জেকেজির চেয়ারম্যান তা স্বীকার করেননি।
আব্দুল বাতেন আরো বলেন, সাবরিনার প্রতিষ্ঠানটির করো’না স্যাম্পল কালেকশনের অনুমোদন ছিল; কিন্তু তাদের সার্টিফিকেট দেয়ার অনুমোদন ছিলো না। তারা অ’বৈধভাবে সেই কাজটি করেছে। তবে যে সার্টিফিকেটগুলো দিয়েছে সেগুলো কতটুকু সত্য মিথ্যা সেই ত’দন্ত এখনো বাকি আছে।
আম’রা আ’দালতের কাছে সাবরিনার আরো রি’মান্ড আবেদন করবো। যে বিষয়গুলো বাকি আছে আমাদের সন্দিহান সে বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলবো।
ডিবির সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা সব সময় নিজের দায় এড়িয়ে চলছেন। কিন্তু তিনি যে প্রতারণার সাথে জ’ড়িত এরই মধ্যে বেশ কিছু প্রমাণ মিলেছে।
এদিকে ত’দন্ত-সংশ্লিষ্ট একজন নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেছেন, সাবরিনা তো দারুণ স্মা’র্ট। গ্রে’প্তারের আগেই মনে হয়ে তিনি কারো কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কী’ভাবে ত’দন্ত কর্মক’র্তাকে মোকাবিলা করবেন। কী’ভাবে কতটুকু উত্তর দেবেন।
ভ’য়ংকর প্রতারণায় লিপ্ত প্রতিষ্ঠান জেকেজির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি বরাবরই এড়িয়ে যাচ্ছেন ডা. সাবরিনা আরিফ চৌধুরী। তবে নিজের রেখে দেয়া প্রমাণ সামনে আনলেও তা আনঅফিসিয়াল বলে দাবি করছেন তিনি। তথ্য সূত্র: ডেইলি সংবাদ